এক চিলতে রোদ্দুর।


খুব সাবধানে পায়ের আওয়াজ বাঁচিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো সুচেতনা। পবিত্র ওপাশ ফিরে এখনও ঘুমাচ্ছে।
বাথরুমের লাইট জ্বেলেই দুফোঁটা ইউরিন ফেললো প্রেগনেন্সি টেস্ট কিটটার মধ্যে। ক্যালেন্ডারে দাগ দেওয়া আছে, 28th এপ্রিল ওর পিরিয়ড ডেট ছিল গতমাসে। আজ 2রা জুন, তার মানে পাঁচদিন পিছিয়েছে। না এখনও কোনো লক্ষণ নেই, পায়ে যন্ত্রনা বা কোমরে যন্ত্রনা হচ্ছে না অন্য বারের মত। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই যদি গুড নিউজটা পেয়ে যায় ও তাহলে হয়তো আজ রায়চৌধুরী বাড়ির সকালের চায়ের সাথেই খবরটা দিয়ে সকলের দুশ্চিন্তা লাঘব করতে পারবে। মনের মধ্যে মারাত্মক আশা নিয়েই তাকিয়েছিল প্রেগনেন্সি কিটের দিকে।
উফ! এবারও নেগেটিভ। প্যাকেট ছিঁড়ে আরেকটা কিট বের করলো সুচেতনা। অনেক সময় ভুল রিপোর্ট আসে বলেই ও মেডিসিন শপ থেকে দুটো কিনেছিলো। আরেকটাতেও যখন পজেটিভ চিহ্ন এলো না তখন ধপ করে বাথরুমের ভিজে মেঝেতেই বসে পড়লো ও।
বারবার ওর সাথেই কেন এমন হয়? বারবার সুচেতনাকেই কেন শুনতে হয়, কি কপাল করেছি আমরা, আর বোধহয় নাতি-নাতনির মুখ দেখে স্বর্গে যেতে পারবো না। কেন শুনতে হয়, জানো সু, মুখার্জীদার বউ সেকেন্ডবার প্রেগনেন্ট হলো! আর তুমি... কেন শুনতে হয়, আমার বোধহয় আর বাবা ডাক শোনা হলো না সু।
ঠাম্মা, দাদু, বাবা ডাকের আকাঙ্খার ভিড়ে মা ডাক না শোনার কষ্টটা হারিয়ে যায় বোবা কান্নার আড়ালে।
বেশ খানিকক্ষণ বাথরুমের ভিজে মেঝেতে বসে থাকলো সুচেতনা। মাথার মধ্যে আবার একরাশ না পাওয়ার বেদনা ভিড় করে এলো। প্রতি মাসে শাশুড়িমা খোঁজ নেন সুচেতনার পিরিয়ডের তারিখের। এমাসেও নিতে ভোলেন নি। বিয়ের প্রায় বছর পাঁচেক অতিক্রান্ত। তাই সমস্ত আত্মীয় স্বজনের কাছেই একরাশ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে চলেছে সুচেতনা। পবিত্র মুখে কিছু না বললেও ওর দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা বেশ অনুভব করে সুচেতনা। অফিস কলিগদের বাচ্চার অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রন রক্ষা করতে যাবার দিনে, অথবা পার্কের পাশ দিয়ে যাবার সময় বাচ্চাদের কোলাহলে অন্যমনস্ক হয়ে যায় পবিত্র। এটা খেয়াল করে বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠেছে সুচেতনার। নিজেকেই দোষী মনে হয়েছে। গাইনকোলজিস্ট দেখিয়ে দেখিয়ে পবিত্রর মাসের মাইনের অর্ধেক ব্যয় হয়েছে, তবুও ইউরিন টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে।
শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে ভাবনার গভীরে ডুব দিতে দিতেই অনুভব করলো, এমাসে পাঁচ দিন পিছিয়ে গেলেও ভুল হয়নি ডিম্বাণুর ক্ষরণে। পা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ওর আশাহত হবার চিহ্ন। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেটটা খুঁজলো সুচেতনা।
প্যাকেটের খচখচ আওয়াজেই ঘুমটা বোধহয় ভেঙে গেল পবিত্রর। ঘুম চোখে তাকিয়েই নীল প্যাকেট হাতে সুচেতনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পবিত্র বললো, একটা করে মাস কেটে যাচ্ছে আশায় আশায়। ওর কথাগুলোর মধ্যেই তীব্র বেদনার ছোঁয়া পেলো সুচেতনা। অপরাধীর মতোই মাথা নিচু করে আবার বাথরুমে ঢুকে গেলো ও।
পুজোর ঘরে ফুল তোলা নেই দেখেই ডাক পড়লো ..বৌমা....
ঠাকুর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচু করে সুচেতনা বললো, আজ আমি ফুল তুলতে পারবো না মা।
হা ঈশ্বর, আমি কি এত পাপী! বলতে বলতেই ঠাকুর ঘর থেকে বাগানের দিকে এগোলেন নন্দিনী দেবী। বিজবিজ করে বলছিলেন,
বংশ শূন্য হবে রায়চৌধুরী পরিবার। নয়তো অজাত কুজাতের কাউকে হয়তো আশ্রম থেকে এনে বংশ রক্ষার নাটক করতে হবে। কথাগুলো খুব একটা আস্তে না বলায় শুনতে পাচ্ছিলো সুচেতনা। রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের জল চাপালো ও। ভারাক্রান্ত মনে কোনো কাজই বোধহয় সুষ্ঠ ভাবে হয় না, তাই সাঁড়াশি ছাড়াই চায়ের সসপ্যানটা হাত দিয়ে ফেলে ডানহাতের বুড়ো আঙুলে বেশ বড় একটা ফোস্কা ফেললো।
না, এই পুড়ে যাওয়া জায়গার ব্যথাটা কাউকে দেখালে চলবে না। তাহলে হয়তো সবাই ভাববে সুচেতনা সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম, আবার সংসারের কাজেও অক্ষম। তাই চুপচাপ চোখের অবাধ্য জলটাকে ওড়না দিয়ে মুছে নিলো ও।
চায়ের টেবিলে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকেই শুনতে পেল, মা বলছেন, খোকা বলছি তোর বিন্দু মাসির বউমার তো প্রায় সাত বছর ধরে মিস ক্যারেজ হয়ে হয়ে গতবছর একটা ছেলে হলো। তো বিন্দু বলছিল, ওই এক্সাইডের কাছে কোনো ডাক্তারের কাছে দেখিয়েই নাকি...
একবার বৌমাকে ওখানে দেখালে হয়না?
পবিত্র হাল ছাড়া গলায় বলল, আর কত মা? গত দু বছরে যত গাইনি আছে সকলের কাছে দেখানো হয় গেছে। দুবছরের এই ডাক্তারদের ফিজ কখনো হিসেব করেছো মা?
বাবা খুব শান্ত গলায় বললেন, সবই ভাগ্য বলে এবার মেনে নাও নন্দিনী।
তাই বলে খোকার কখনো সন্তান হবে না এটা মেনে নিতেও যে আর পারছি না।
সুচেতনা আস্তে আস্তে বললো, মা আজকাল যে ওই টেস্ট টিউব বেবি ....কথাটা শেষ করতে না দিয়েই পবিত্র চেঁচিয়ে উঠে বললো, তা সু তার খরচটা কি তোমার বাবা দেবেন? এই জন্যই বলি, অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী। যা জানোনা সেটা নিয়ে কথা বলতে এসো না। তোমার কোনো ধারণা আছে টেস্ট টিউব বেবির জন্য কত খরচ হয়?
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো পবিত্র। সুচেতনা কি বলবে বুঝতে না পেরে অসহায়ের মতোই শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকালো। মা বললেন, শোনো বৌমা তুমি বরং এ মাস থেকে সোমবারটা পালন করো দেখি। ওই ফ্ল্যাটের অমলা বলছিল, ওর ননদের নাকি সব ডাক্তার জবাব দেবার পরও বাচ্চা হয়েছে। শুনছিলাম, খুব নিষ্ঠা ভরে সোমবার করলে নাকি গর্ভসঞ্চার হয়। সুচেতনা ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়লো।
শনি, মঙ্গল, শুক্রবার তো নিরামিষ খেতই, সঙ্গে না হয় সোমবারটাও যোগ হোক। তবু যদি মা ডাকটা শুনতে পায় ও।
সুচেতনারা তিনবোন। বাবা এক উকিলের আন্ডারে মুহুরী ছিলেন। সেই উকিলের কর্মবিরতির সাথে সাথে বাবাও রিটায়ার করে গেছেন। রিটায়ারের পরেই অবশ্য সুচেতনার বিয়েটা হয়েছিল। ও বাড়ির ছোট মেয়ে। তাই দুই দিদির মত জাঁকজমক করার ক্ষমতা তখন আর বাবার ছিলো না। সেটা নিয়েও এ বাড়িতে এসে শুনতে হয়েছে, তোমার বাবা তো তোমার বিয়েতে হাতের মুঠো ফাঁকও করলেন না। প্রায় নম নম করে কন্যা বিদেয় করলেন।
প্রথম প্রথম সুচেতনার বাবার ওপর রাগ হতো। তারপর বাপের বাড়ি গিয়ে যখন দেখতো, বাবার প্রেশারের ওষুধটা তিনদিন ফুরিয়ে যাবার পরেও কেনা হয়নি, অথবা বাবা সিগারেট ছেড়ে বিড়িতে অভ্যস্ত হয়েছেন তখন আর রাগ হয়নি বরং বাবার পাকা চুলের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হয়েছিলো। মনে হয়েছিল, মানুষটা নিজে তো কোনোদিন ভোগ করলেন না, তিন তিনটে মেয়েকে পড়াশোনা শেখাতে, বিয়ে দিতেই কাটিয়ে ফেললেন জীবনের তিনভাগ। এরপরে আর বাবা মায়ের ওপরে রাগ অভিমান করার জায়গা থাকে না। আর রায়চৌধুরী বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও এই বাড়ি ওর নিজের হলো কই। এত বছর পরেও তো ও পরের বাড়ির মেয়েই রয়ে গেল। এ বাড়িতে অপমান নামক শব্দটার মাত্রা লঘু করেই বেঁচে আছে গত পাঁচ বছর।
বড়দি গত কালও ফোন করে বলেছিলো, সু দেখিস এবারে ভগবান তোর দিকে মুখ তুলে চাইবেন। বড়দিকে কি একবার ফোন করে বলবে, যে এবারেও নেগেটিভ।
হোয়াটস আপে মেসেজটা ঢুকলো, বিপ টোনে জানান দিলো তার আগমন বার্তা।
একটা অজানা নাম্বার থেকে মেসেজ ঢুকলো।
সুচেতাদী প্লিজ মন খারাপ করোনা। আমি তো আছি তোমার সাথে। নিচের ভিডিওটা দেখ , তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।
সুচেতনা বুঝতে পারছে খুব পরিচিত কেউ এমন লিখছে। যার কাছে ওর ফোন নাম্বার আছে। যদিও ওর এই নাম্বারটা সেই কলেজ লাইফের। তাই বহু বন্ধুর কাছেই ছিল। তাদের মধ্যেই হয়তো কেউ...
তুমি কে বলো তো, আমাকে চেনো?
দু সেকেন্ড পরেই টাইপ হলো, ওমা চিনবো না কেন, তুমি আমার শয়নে স্বপ্নে আজও বিরাজ করো।
তারমানে কোনো বন্ধু দুস্টুমি করছে। কলেজে ওকে কেউ সুচেতনা বলতো না। কেউ সু, কেউ সুচেতা, কেউ চেতা বলেই ডাকতো। তারমানে পরিচিত কেউই হবে।
বেশি না ভেবে নিচের ভিডিওটা ক্লিক করলো।
পরপর ভেসে উঠছে নিজের মুখ।
বিভিন্ন নাচের মুদ্রায় সুচেতনা। কখনো বসন্ত বন্দনায় পলাশ রঙের শাড়িতে ও, কখনো রবীন্দ্র জয়ন্তীতে সাদা শাড়িতে ও। অন্তত গোটা কুড়ি নাচের ছবি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ভিডিওটা।
সুচেতনার ধমনীর মধ্যে দিয়ে তখন রিমঝিম ছন্দে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। হঠাৎ করেই অবাধ্য পা দুটো মাটিতে ঠুকে দুবার কত্থকের তাল প্রাক্টিস করে নিলো যেন!
চোখের সামনে ভেসে উঠলো, চন্দননগরের রবীন্দ্র ভবনের স্টেজটা। সুচেতনার নাচ শেষের পরে দর্শকদের অবিরাম হাততালির আওয়াজ ভেসে এলো কানে।
যেদিন বাবার কাছে দত্ত কাকু এলো পবিত্রর সাথে সুচেতনার সম্বন্ধ নিয়ে, সেদিন দত্ত কাকু বলেছিলেন, রায়চৌধুরীরা আগে খুব সম্ভ্রান্ত ছিল। এখন ভাইয়ে ভাইয়ে ভাগ হয়ে গিয়ে সব সম্পত্তির বাটোয়ারা হয়ে যাওয়ায় অবস্থা পড়ে গেছে। তাই এমন নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘর থেকে মেয়ে নিচ্ছে ছেলের বিয়ের জন্য। আগেকার অবস্থা হলে নাকি, ওই বাড়িতে সুচেতনার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবার সাহসই পেতো না দত্ত কাকু। বাবা তখন নেহাতই কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার ভূমিকায়। তাই খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরেছিলেন দত্ত কাকুর হাত দুটো। পাত্রের মা নাকি একটু ঘরোয়া মেয়ে চান!
বাবা সরল বিশ্বাসে বলেছিলেন, আমার তিন মেয়েই ঘরোয়া ভাই। মুচকি হেসে দত্ত কাকু বলেছিলেন, তুমি হাসালে দাদা। তোমার ছোট মেয়ে স্টেজে নেচে বেড়াচ্ছে আর বলছো কিনা ঘরোয়া! সেদিন থেকেই সুচেতনার কাছে ঘরোয়া, শান্ত মেয়ের সংজ্ঞা বদলে গিয়েছিল। ও বুঝেছিলো, নিজেকে ঘরোয়া প্রমান করতে ওকে পা থেকে ঘুঙুর খুলতে হবে। শান্ত বোঝাতে ওকে, আজ থেকে 'বোবার কোনো শত্রু নেই' এই নিয়মে চলতে হবে। তবেই বাবার কপালের দুশ্চিন্তার চিরস্থায়ী রেখাগুলোর নিরাময় হতে পারে। মায়ের করুন চাহনির আকুতিতেই সেই ছোট্ট থেকে শেখা ভালোবাসাটার জলাঞ্জলী দিতে হয়েছিলো ওকে। বাড়ির পাশের রেবতীদিকে গিয়ে জানিয়ে এসেছিলো সুচেতনা, ও আর নাচতে পারবে না। রেবতীদি কখনো এক টাকা মাইনে না নিয়েই শিখিয়েছিলো তার প্রিয় ছাত্রীকে। যে কোনো প্রতিযোগিতার পর গর্ব করে বলতো, সু আমার কাছে নাচ শেখে। এটাই ছিল রেবতীদির প্রাপ্তি। সেই রেবতীদি যখন জেনেছিলো, সুচেতনা নিজেকে ঘরোয়া লক্ষ্মী মেয়ে প্রমান করবে বলে আর নাচবে না, তখন রেবতীদি অঝরে কেঁদে বলেছিলো, তুইও সেই শান্ত, ঘরোয়া, গৃহকর্মে নিপুনার দলে নাম লেখালি সু? এগুলো করলে বুঝি নাচ করা যায় না? কে বলল, যারা নাচে তারা সংসার করতে পারে না? রেবতীদি, আমি ছন্দকে দূরে সরালাম, কিন্তু নৃত্যকে ভুলবো না কখনো। স্বয়ং নটরাজকে তুমি যে আমার রক্তে মিশিয়ে দিয়েছো।
মাস দুয়েকের মধ্যেই লাল বেনারসী আর মাথায় সিঁদুর পরে রায়চৌধুরী বাড়ির চৌকাঠে পা রেখেছিলো সুচেতনা। আর ঠিক সেদিন থেকেই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সাথে স্বাধীনতা নামক শব্দটাকে বিদায় জানিয়েছিল। তবুও মন্দ লাগেনি, পবিত্রর আদরে সোহাগে সুচেতনার অস্তিত্বকে সম্পুর্ন ভুলে এই বাড়ির বউ সাজতে। কিন্তু ঠিক যেদিন থেকে বাড়ির সকলে বুঝতে পারলো, সুচেতনা ওদের বংশ রক্ষায় অপারগ সেদিন থেকেই মানসিক দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিলো ও।
সমস্ত ডাক্তারেরা পরিষ্কার জানিয়েছেন, সুচেতনার কোনো রকম শারীরিক সমস্যা নেই, তাহলে কেন পারছে না ও মা হতে।
কদিন আগেই সাহস করে পবিত্রকে ট্রিটমেন্টের জন্য বলেছিলো ও। পবিত্র অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলেছিলো, সু! নিজের অক্ষমতা অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চাইছো? আত্মীয়-পরিজনদের কাছে এটাই প্রমান করতে চাইছো তো, যে আমার প্রবলেমের জন্য তুমি মা হতে পারছো না?
ভয়ে সংকুচিত হয়েছিলো সুচেতনা। বোধহয় পুরুষত্বের অহংকার আঘাত দিয়ে ফেলেছিলো ও। তবুও সামলে নিয়ে মরিয়া হয়ে বলেছিলো, তুমি কি চাও না পবিত্র, আমরা বাবা-মা হই। তাই ...
ওর কথা শেষ হবার আগেই পবিত্র বলেছিলো, ঠিক আছে কাল দেখিয়ে আসবো ডক্টর।
সপ্তাহ খানেক পরে হঠাৎ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে রাগে ফেটে পড়েছিলো পবিত্র। বাবা-মায়ের সামনেই বলেছিল, সুয়ের কথায় আমাকেও যেতে হয়েছিলো ডাক্তারের কাছে। জানতে যেতে হয়েছিলো, কার দোষে এ বাড়িতে সন্তান আসছে না।
শুনেই মা মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিল, চুপ কর খোকা, চুপ কর। আমি তো ভাবতেই পারছি না বৌমা তোকে অব্দি দোষারোপ করতে পারে!! নিজের দোষ তোর ঘাড়ে চাপাতে পারে ভেবেই অবাক লাগছে। সেদিন সারারাত ঘুমন্ত পবিত্রর পাশে শুয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল সুচেতনা। মাঝরাতে উঠে পবিত্র বলেছিলো, তোমার এই ছিঁচকাঁদুনে কান্নাটা না হয় বাপের বাড়ি গিয়ে কেঁদো। আমাকে ডক্টরের কাছে পাঠানোর সময় তোমার একবারের জন্যও মনে হয় নি, তুমি নিজের স্বামীকে অপমান করছো?
সুচেতনা মধ্যরাতের একফালি চাঁদকে সাক্ষী রেখে পবিত্রর পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলো। আবার কয়েকদিন পরে দুজনের শরীর মিশেছিলো নতুন উদ্যমে। শুধু শারীরিক আকাঙ্খায় নয়, সন্তান লাভের আশায় অপমান নামক শব্দটাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল সুচেতনা। এ বাড়ির হাজার অপমান সূচক কথার উত্তর দিতে চায় ও। একটা মা ডাকের আশায় বারংবার পবিত্রর কাছে ছুটে গেছে সুচেতনা। প্রতিবার ব্যর্থ হয়েছে ওর চাওয়া। মাসের নির্দিষ্ট তারিখে ও আবার ঋতুমতী হয়েছে। কাউকে বোঝাতে পারেনি পবিত্রর যেমন কোনো শারীরিক সমস্যা নেই, তেমনি সুচেতনাও বন্ধ্যা নয়, ও সুস্থ। পাড়া-প্রতিবেশীর একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ও ক্লান্ত। এমন কি নিজের মাও বললো, কি কপাল করেছিলাম....তাই আজ বেয়ান বাড়ি থেকেও কথা শুনতে হলো। আমরা নাকি খুঁতে মেয়েকে ওদের বাড়িতে গছিয়ে দিয়েছি।
অসহ্য লাগে সুচেতনার। বাঁচার সব ইচ্ছেটুকু ধীরে ধীরে শেষ হতে বসেছে। কোনো শুভ অনুষ্ঠানের আচারে ওকে হাত দিতে দেন না বাড়ির গুরুজনেরা।
তারই মধ্যে একটু নিঃশ্বাস নেবার মত ঠান্ডা বাতাস দেয় হোয়াটস আপের ওই অপরিচিত নাম্বারটা। রোজই সুচেতনার কোনো না কোনো নাচের ছবি সে পাঠাবেই। সঙ্গে লেখে দু চার লাইন।
সেদিন যেমন একরাশ মনখারাপ নিয়ে মুঠোফোনটা হাতে নিতেই মেসেজটা ঢুকলো...
তোমার মনের মনখারাপি বাতাসটাকে আমি মন্ত্রবলে টেনে নেব নিজের কাছে। আর পরিবর্তে পাঠাবো একমুঠো বৃষ্টি। সারাদিন ধরে তুমি ভিজবে সেই বৃষ্টিতে। তুমি নাচবে বৃষ্টির তালে তালে। আমি শুধু দূর থেকে দেখবো তোমাকে।
সুচেতনা লিখেছিল, আমি আর নাচি না। না, ও আর জানতে চায়নি অজানা মানুষটি কে! জানতে চাইলে যদি মানুষটা পালায়। তাহলে তো নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে যাবে ওর। তাই বেঁচে থাকার জন্যই ওই অজানা নম্বরটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। খুব ইচ্ছে করছিল সুচেতনার, যদি ওই মানুষটির গলাটা একবার শুনতে পেতো.... এই একটা মানুষই ওকে বলে, মা হওয়া যেমন গর্বের, তেমনি নারী হওয়াও কিন্ত গর্বের। তুমি তো মা হতে গিয়ে নারী সত্ত্বাকে ভুলে যেতে বসেছো।
সুচেতনা রক্ত ঝরিয়ে লিখেছিল, কোনোদিন কি আমাদের দেখা হবে না? কোনোদিন কি তুমি নিজের পরিচয় দেবে না আমার কাছে? আমি তো খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি তুমি আমাকে ভীষন ভালো করে চেনো। আমার প্রতিটা নাচের প্রোগ্রামে তুমি গেছো। এমনকি আমার এত সুন্দর ছবিগুলোও রয়েছে তোমার কালেকশনে। বলো না, কে তুমি? শুধু নামটা বলো!
সুচেতনার কাকুতি মিনতিতে মানুষটি বলেছিলো, ঠিক আছে সুচেতাদি কখনো যদি কোনো প্রয়োজনে তুমি ডাকো আমায়, আমি যাবোই তোমার কাছে। তার আগে পর্যন্ত এটুকু আড়াল থাক আমাদের মাঝে।
সুচেতনা বলেছে তুমি কি পুরুষ?
মানুষটি লিখেছে, প্ৰথমে আমি একজন মানুষ, তারপরে আমি পুরুষ। পুরুষত্বের মিথ্যে অহংকার নেই আমার মধ্যে।
রায়চৌধুরী বাড়িতে উঠতে বসতে অপয়া ,অলুক্ষনে শুনতে শুনতে চোখের জল প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিলো সুচেতনার। ইদানিং পবিত্রও আর খুব বেশি কথা বলে না ওর সাথে। সম্পর্কের ঘুড়িটা মাঝ আকাশে ছিঁড়ে গিয়ে সুতো সমেত এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছে। লাটাইটা আর হাতে নেই ওর, তাই কোনোভাবেই ঘুড়িটাকে নিজের কাছে আনতে পারলো না সুচেতনা। শাশুড়ি মা ফোনে লোকের কাছে দুঃখ করে বলছেন, কি আর করবো বলো, বাঁজা মেয়েকে নিয়েই আমার খোকাকে কাটাতে হবে বাকি জীবনটা।
অদ্ভুত একটা বোবা কষ্টে বিদ্ধ হতে হতেই ঘরের সব জিনিস ওলটপালট করতে শুরু করলো সুচেতনা। এলোমেলো চুল, শাড়ির আঁচল বিধস্ত, চোখের নিচে গাঢ় অন্ধকার।
পাগলের মত তছনছ করছিলো ও। হঠাৎই পবিত্রর কাবার্ড থেকে স্কাই কালারের স্বচ্ছ ফাইলটা পড়লো চোখের সামনে। নিশ্চয়ই কোনো মেডিকেল রিপোর্ট। সারা ঘরে শুধু মিসেস সুচেতনা রায়চৌধুরীর মেডিকেল রিপোর্ট ছড়ানো। যে যা বলেছে তাই টেস্ট করা হয়েছে। সবই নরম্যাল, তারপরেও ও পরিচিত হয়েছে বন্ধ্যা বলে। এই সব রিপোর্টগুলো একসাথে জ্বালিয়ে দিতে হবে আজ। কোনো মূল্য নেই, এসব মিথ্যে কথার। রিপোর্টগুলো জড়ো করছিলো সুচেতনা।
মাসতুতো ননদের সাধের অনুষ্ঠানে বেরিয়ে গেছে বাড়ির সকলে। সাধের অনুষ্ঠানে যেতে পারেনি সুচেতনা। ও গেলে যদি ওই গর্ভবতীর ক্ষতি হয় বলেই এই সাবধানতা নিয়েছেন শাশুড়িমা। সব ফাইলগুলো পাগলের মত খুলছে সুচেতনা। বের করে আনছে নিজের ডাক্তারি রিপোর্টগুলো। দুচোখে নোনতা জলের ধারায় ভিজে যাচ্ছে গাল থেকে চিবুক।
হাতের এই রিপোর্টটাতে সুচেতনার নয়, পবিত্রর নাম লেখা আছে। ভালো করে চোখটা মুছে তাকাতেই দেখলো, এটা পবিত্রের স্পার্ম কাউন্টিংএর রিপোর্ট।
ওহ, এই সেই রিপোর্ট যেটা করাবার পর, পবিত্র বলেছিলো, লজ্জা করে না তোমার! আমার পুরুষত্বকে অক্ষম প্রতিপন্ন করে নিজের নারীত্বকে বন্ধ্যা বলা থেকে আটকাতে চাইছো? লজ্জায় সত্যিই অধ:বদন হয়ে গিয়েছিলো সুচেতনা।
এ কি দেখছে ও...
ও কি সত্যিই ঠিক দেখছে?
নাকি মাথার সাথে ওর চোখেরও গন্ডগোল হয়ে গেছে?
সুচেতনার বান্ধবী সীমার হাজবেন্ড ডাক্তার। এক সেকেন্ডও দেরি না করে রিপোর্টের একটা ছবি তুলে সীমার হোয়াটস আপে পাঠিয়েই লিখলো, পরে নয় সীমা। প্লিজ হেল্প। তোর হাজবেন্ডকে এখুনি দেখিয়ে বল, এটা কি বলতে চাইছে।
সীমার রিপ্লাই এলো...দশ মিনিট সময় দে প্লিজ।
ও চেম্বারে বেরোনোর জন্য রেডি হচ্ছে। আমি দেখাচ্ছি।
সময়গুলো কাটতেই চাইছে না ....
বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডের দ্রুতগামীতা টের পাচ্ছে সুচেতনা। সব রিপোর্টগুলো জ্বালিয়ে সেই আগুনেই নিজেকে ধ্বংস করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সেই সকাল বেলায়। যখন শাশুড়িমা বললেন, দেখো আবার শাড়ি পরে খুকি সেজে যেন রিয়ার সাধের অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির হয়ো না। তাহলে আর ওদের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না। ভাববে আমাদের ঘর শূন্য বলেই লোকের ক্ষতি করতে আমরা তোমাকে নিয়ে গেছি ওদের বাড়ি।
ঠিক সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সুচেতনা...আর বোধহয় বেঁচে থাকার অর্থ নেই।
সীমা কল করেছে...
কাঁপা গলায় ফোনটা ধরলো সু।
সীমা বললো, আমার হাজবেন্ডের সাথে কথা বল...
ভদ্রলোক বেশ গম্ভীর গলায় বললেন , দেখুন সুচেতনা দেবী এটা জাস্ট লস্ট কেস। যদিও আমি নিউরোলজিস্ট, তবুও রিপোর্ট দেখে বেশ বুঝতে পারছি, ওনার স্পার্ম কাউন্টিং এতটাই কম যে উনি সন্তান ধারণে অক্ষম। দেখুন রিপোর্টের পাশের নরম্যাল নম্বরের থেকে ওনারটা ঠিক কতটা কম। মেডিসিনের মাধ্যমে স্পার্ম কাউন্টিং বাড়ানো সম্ভব , কিন্তু সেটা একটা মাত্রা পর্যন্ত ....এক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয় বলেই মনে হচ্ছে। তবুও আপনারা ট্রাই করে....
কথাটা শেষ হবার আগেই ফোনটা কেটে দিলো সুচেতনা। ডাক্তারি ভাষা না বুঝলেও এটুকু বুঝেছে, যে কার শারীরিক অক্ষমতায় ওদের আজ পর্যন্ত সন্তান এলো না। বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো ওর। যার জন্য ও মা ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত হলো সেই ওকে এতবড় প্রবঞ্চনা করলো। শনি, মঙ্গল, সোম বারের উপোষ করে করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের হাজার চেষ্টা বৃথা হয়ে গেছে ওর, কত কত ওষুধ, গাছ গাছালির রসে পেটের মধ্যে চড়া পড়ে গেছে ওর....তবুও ওই মানুষটা একবারের জন্যও সকলের সামনে দাঁড়িয়ে বলেনি, যে দোষটা তার...সুচেতনার নয়। এটা কি পুরুষত্ব?? তাহলে মানবিকতা কার নাম? ভালোবাসা কার নাম?
আজ ওই অজানা নাম্বারে ফোনটা করেই ফেললো সুচেতনা।
ফোন ধরেই পুরুষ কন্ঠ বললো, বলো সুচেতা দি... নিয়ম ভেঙে ফোন কেন হঠাৎ?
কঠিন কণ্ঠে সুচেতনা বললো, ভালোবাসো না আমাকে, খুব ভালোবাসো!! আমি যা বলবো করতে পারবে বলে অনেক গর্ব করেছো তুমি। এখুনি চলে এসো আমার শ্বশুর বাড়িতে।
ফোনটা কেটে দিয়েছে সুচেতা দি। কিন্তু গলা শুনেই বুঝতে পেরেছে সাগ্নিক, সামথিং ভেরি আর্জেন্ট। সুচেতাদিকে তো আজ থেকে দেখছে না ও।
ওর যখন ক্লাস ফোর তখন সুচেতাদি ক্লাস এইটের ছাত্রী। প্রথম যেদিন মায়ের কাছে নাচ শিখতে এসেছিল সেদিনই অবাক চোখে দেখেছিলো সাগ্নিক। মায়ের এত এত ছাত্রীর মধ্যে কেন যে সুচেতাদিকেই এত ভালো লাগতো তা কখনো বোঝেনি ও। শুধু এটুকু বুঝেছিলো, ও যখন মঞ্চে নাচতো তখন মনে হত স্বর্গের কোনো অপ্সরী ভুল করে পৃথিবীতে নেমে এসেছেন। মা বলতো, সু এর পায়ের ছন্দে পৃথিবী ভয় পায়, ওর হাতের মুদ্রায় বাতাস থেমে যায়। সাগ্নিক ওকে ক্লাস ফোরে নোটিস করলেও সুচেতাদি নাকি আরো পাঁচ বছর আগে থেকেই নাচ শিখছিলো। প্রতিদিন পড়া ভুলে মায়ের নাচের ক্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকতো না সাগ্নিক। শুধুমাত্র যেদিন সুচেতাদির ক্লাস থাকতো, সেদিনই বিশ্ব সংসার ভুলে যেত ও। ক্লাস শেষ করে বেরোনোর সময় সাগ্নিকের মাথায় হাত বুলিয়ে, গালটা টিপে দিয়ে আদর করে চলে যেত ও। কিন্তু সাগ্নিক যখন ক্লাস নাইন আর সুচেতাদি সদ্য কলেজে উঠেছে তখনই ভয়ংকর ভুলটা করে ফেলেছিল ও। ক্লাস শেষ করে ওদের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিলো সুচেতাদি, ঠিক সেসময় সাগ্নিক দুপাতার প্রেমপত্রটা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই ওর হাতে দিয়ে বলেছিল, I love you।
প্রায় আধঘণ্টা পরে ওকে আবার সাগ্নিকদের বাড়ির দরজায় দেখেই মুখ শুকিয়ে গিয়েছিলো ওর। একবার যদি চিঠিটা মায়ের সামনে পড়ে তাহলে যে কি কি হবে ভাবতেই পারছে না সাগ্নিক। এ অঞ্চলে নাচের কড়া টিচার বলে রেবতী গোস্বামীর নাম আছে।
সুচেতাদি আস্তে আস্তে বলেছিল, আজ বিকেলে দীঘির পাড়ে দেখা করবো, কথা আছে। সারাদিন পাগল পাগল অবস্থা ছিল সাগ্নিকের।
সুচেতাদি কলেজের কোনো ছেলের সাথে কথা বললেও ভীষন রাগ হতো সাগ্নিকের। ও শুধুই সাগ্নিকের। ওর প্রতিটি কোষকলার ওপর অধিকার একমাত্র সাগ্নিকের।
এমনই ভেবে এসেছে সেই ছোট্ট থেকে।
একটা ময়ূরকণ্ঠী রঙের চুড়িদার পরে দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল সুচেতাদি। ঢিপঢিপ বুক নিয়ে সাগ্নিক সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
মাথা নিচু, চোখ নিচের দিকে... দেখেই সুচেতাদি বলেছিলো, এমন কাজ কেন করলি সাগ্নিক যাতে নিচের দিকে চোখ করে রাখতে হয়?
তারপরেই শান্ত গলায় ও বলেছিল, শোন পাগল তুই কোনো অন্যায় করিস নি। ভালোবাসা কোনো অন্যায় নয়। তবে মুস্কিলটা কি বলতো, আমাদের সমাজের কিছু কিছু নিয়ম আছে। তুই আমার থেকে অনেকটা ছোট, তাই তোর ভালোবাসাকে ঠিক প্রেমিকের ভালোবাসা বলা যায় না রে। সাগ্নিক আস্তে আস্তে বলেছিলো, কিন্তু আমি তো একদিন বড় হবোই।
সুচেতাদি হেসে বলেছিলো, হ্যাঁ সেই বড় হবার পরে যাকে ভালোবাসবি সেটাই হলো আসল ভালোবাসা বুঝলি পাগল। এসব কথা আর কাউকে বলিস না, লোকে তোকে খারাপ ভাববে, আর তোকে খারাপ ভাবলে আমার কষ্ট হবে রে!
চলে গিয়েছিল সুচেতাদি। নীরবে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সাগ্নিক।
তারপর ভেবেছিলো, বেশ, বাসতে হবে না সুচেতাদিকে ভালো, ও যদি বাসে সেটাকে আটকানোর ক্ষমতা তো কারোর নেই। সেই তবে থেকেই মনেমনে ওকে ভালোবাসে সাগ্নিক। ওর যখন ভালোবাড়িতে বিয়ে হলো, তখন ও চলে যাবে ভেবে কষ্ট হলেও খুব আনন্দও হয়েছিল সাগ্নিকের। সুচেতাদি ভালো থাকবে ভেবেই আনন্দ পেয়েছিল ও।
দিন কেটে গেছে, বছর ঘুরে গেছে...মাঝে সাজে সুচেতাদিকে দেখেছে বাপের বাড়ি এসেছে, মায়ের সাথেও দেখা করে গেছে। একবারও জানতে পারেনি, সাগ্নিকের দিন শুরু হয় ওর নাচের ছবি দেখে। মায়ের অ্যালবাম থেকে ওর সব ছবি এখন সাগ্নিকের জিম্মায়। ওর দিকে তাকিয়ে সুচেতাদি বলেছিল, বাপরে কত বড় হয়ে গেছিস তুই...গোঁফ গজিয়ে গেছে তো।
লজ্জা পেয়েছিল সাগ্নিক, সাথে ওর চোখে বড় হয়েছে শুনেছে আনন্দও পেয়েছিল।
তারপরে প্রথম হোয়াটস আপ ডাউন লোড করেই ওর চেনা নম্বরে পিং করেছিলো ও।
মায়ের কাছেই শুনেছিল, বাচ্চা হচ্ছে না বলে নাকি ডিপ্রেশনে ভুগছে সুচেতাদি।
সাগ্নিক চেষ্টা করতো, নানা ছবি, কবিতার লাইনের মাধ্যমে ওর ডিপ্রেসন কাটাতে। অপরিচিতের আড়ালেই রেখেছিলো বন্ধুত্বটাকে।
তবে একটা জিনিস অবাক লাগলো... ওর গলাটা চিনতে পারলো না সুচেতাদি। তাহলে কি বড়সড় কোনো মানসিক বিপর্যয়ে আছে ও, তাই চিনতে পারলো না?
ওর শ্বশুর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই ভাবলো, ফিরে যাবে কি? যদি ওর স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির সকলে কিছু বুঝতে পারে! তবুও সুচেতাদি যখন ডেকেছে তখন সম্মুখীন ওকে হতেই হবে। কারণ সাগ্নিক কথা দিয়েছিলো, তুমি যেদিন সত্যি করে ডাকবে সেদিন আমি ঠিক হাজির হবো। বেলটা বাজতেই বাড়ির ভিতরে সুন্দর মিউজিক বেজে উঠলো। সেই কবে বিয়ের দিন বর নিতে এসেছিলো ওর শ্বশুরবাড়িতে।
শীতের এক সন্ধ্যায় পবিত্রদাকে ফুল সাজানো গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছিলো সাগ্নিক। আজ আবার এলো....
এলোথেলো শাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল। চোখের নিচে কয়েক রাত্রি জাগরণের ছাপ। সাগ্নিককে দেখেই বিরক্ত মুখে বললো, কি রে তুই হঠাৎ?
তারপরেই দুশ্চিন্তার রেখারা স্পষ্ট হলো সুচেতাদির মুখে।
বাবা- মা, রেবতীদির কিছু হয়নি তো? এই সাগ্নিক, বোকার মত না তাকিয়ে থেকে বল....
সাগ্নিক তখনও বিস্ময়ে হতবাক। এই মেয়েটাই কি সেই মেয়েটা...যার নাচের মুদ্রায় ছিলো স্বর্গীয় বিভঙ্গ, যার প্রতিটা চলার ছন্দে ধরিত্রী জেগে উঠতো এককালে। এই মেয়েটাই কি সেই মেয়েটা, মঞ্চে যার চোখের চঞ্চল আঁখি দেখে সাগ্নিকের প্রথম কবিতা লেখা!! এ যে অর্ধমৃত কোনো প্রতিমা!
অস্ফুটে ও বললো, কি করে হলো সুচেতাদি? নিজেকে এভাবে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছ কেন?
সুচেতনার চোখে বিস্ময়!
তুই...তুইই আমাকে হোয়াটস আপে..
আর কথা না বলে ও বললো, আয় ভিতরে আয়।
সাগ্নিককে নিয়ে গেল নিজের বেডরুমে। চারিদিকে কাগজ,ভাঙা ফুলদানি, জামা কাপড় ছড়ানো...দেখেই মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে সব ভাঙতে চাইছে, সাগ্নিককে একটা চেয়ারে বসতে বলেই নিজের শাড়ির আঁচলটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো সুচেতাদি।
তারপর অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো সাগ্নিকের দিকে...
তুই আমাকে সেই ছোট্ট থেকে ভালোবাসিস তাই না? আজ প্রমান কর তুই আমাকে সত্যিই ভালোবাসিস....
প্রমান কর, আমি বন্ধ্যা নই, আমার শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। আমি মা ডাক শুনতে চাই, বাঁজা নামটা ঘোঁচাতে চাই...
থরথর করে কাঁপছে সাগ্নিক..
এ ও কাকে দেখছে? কোথায় গেলো ওর সেই সংযমী, মিতভাষী, অথচ উচ্ছল সুচেতাদি। রোজ যাকে স্বপ্নে দেখতো, যাকে দেখতে পেতো মায়ের ঘরের বিরাট নটরাজ মূর্তির অবয়বে।
সুচেতাদির জন্য আনা গিফ্টগুলো হাত থেকে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে গেলো নিজের অবচেতনেই।
কল্পনার মানবীর সাথে বাস্তবের মেয়েটার এতটা তফাৎ মেনে নিতে পারছে না সাগ্নিক।
ও ধীরে ধীরে বললো, সুচেতাদি আমি তোমাকে ভালোবাসি। হ্যাঁ প্রেমিকের মতোই ভালোবাসি। কিন্তু তোমার শরীর কামনা করে নয়। তুমি আমার কবিতার সেই নারী, যাকে আমি ভোরের স্নিগ্ধতায় অনুভব করি। যাকে আমি ধ্রুবতারার মত মনে করি। যাকে দেখে পথ হারানো নাবিক খুঁজে পাবে আলোর দিশা...
আজ আমি এসেছিলাম তোমাকে একটা খবর দিতে। মা মায়ের কলকাতার স্কুলটার সমস্ত দায়িত্ব তোমাকে দিতে চায়, তাই আমি মাকে বলেছিলাম, যে আমি তোমাকে রাজি করাবো আবার নাচতে।
তোমার পায়ে আবার ঘুঙুরের বোল বেজে উঠবে , জীবন্ত হয়ে উঠবে ঘুমন্ত নারী সত্ত্বা। সেখানে তুমি কিনা....
ছি সুচেতাদি, আমি কাকে ভালবাসলাম এতদিন ধরে!
সাগ্নিকের কথা শেষ হবার আগেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সুচেতনা। আজ ও সাগ্নিকের চোখেও ছোট হয়ে গেলো। মাটিতে মিশে গেল ও।
ঠিকই তো মাতৃত্ব একজন নারীকে পরিপূর্ন করে ঠিকই, তাই বলে সেই মাতৃত্ব পাবার জন্য নিজেকে বিকিয়ে দেবে কেন?
মেঝেতে ছড়িয়ে আছে একজোড়া ঘুঙুর। একটা ছোট্ট নটরাজের মূর্তি, আর বেশ কতগুলো সুচেতনার পুরোনো নাচের ছবি।
নিজেকে সামলে নিয়েছে সুচেতনা।
গম্ভীর ভাবে বললো, তোর ক্লাস নাইনে, দীঘির পাড়ে আমি তোকে ক্ষমা করেছিলাম, আজ পারবি না আমাকে ক্ষমা করতে...কি রে সাগ্নিক বল, পারবি না?
সাগ্নিক বললো, জানো সুচেতাদি, যাকে মানুষ খুব ভালোবাসে তাকে বোধহয় ঘৃণা করলেও তা ভালোবাসারই নামান্তর হয়।
বলো, কবে থেকে দক্ষিণাপনের কাছে মায়ের নতুন স্কুলটার দায়িত্ব নেবে? মায়ের বয়েস হয়েছে, আর নিজে পারে না। সব প্রিয় ছাত্রীদের ওপরে দায়িত্ব দিয়েই টিকিয়ে রাখতে চায় মায়ের শিল্পীসত্ত্বাকে।
চোখের জল মুছে সুচেতনা বললো, কিন্তু এরা যে নাচ পছন্দ করে না!
সাগ্নিক হেসে গিফ্টগুলো তুলতে তুলতে বললো, এবার একটু নিজের পছন্দের গুরুত্ব দাও সুচেতাদি। এতগুলো বছর তো সবার ভালো দেখলে।
চলে গেছে সাগ্নিক।
একা নিশ্চুপ হয়ে বসেছিলো সুচেতনা। বাইরে গাড়ির আওয়াজ... এরা বাড়ি ফিরলো। সন্ধ্যে নেমেছে তিলোত্তমাতে। চারিদিকে আলোর মালায় সেজে উঠেছে কল্লোলিনী।
ঘরোয়া মেয়েটা আজ প্রতিবাদিনী।
হাতে পবিত্রর মেডিকেল রিপোর্টটা নিয়ে সোজা ড্রয়িংয়ে ঢুকলো ও।
শ্বশুর মশাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললো, আপনি তো শিক্ষিত মানুষ। আশা করি বুঝবেন। রিপোর্টটা দেখেই পবিত্র ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘের মত। সুচেতনা বললো, লাভ নেই পবিত্র। আমি ছবি তুলে রেখেছি। দিনের পর দিন নিজের অক্ষমতাকে ঢেকে তুমি আমাকেই দোষী করে গেছো।
শ্বশুর মশাই শাশুড়ি মাকে বলতেই উনি বললেন, এসব ঘরের কথা পাঁচ কান না হওয়াই ভালো।
সুচেতনা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললো, আমি তো ঘরোয়া মেয়ে মা, তাই এসব কথা ঘরেই রাখবো।
পরেরদিন সুন্দর করে নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে, ব্যাগেতে ঘুঙুর জোড়া নিয়ে চললো ও। অন্য এক নারী সত্ত্বার পুনরায় বিকাশ ঘটাতে।
পবিত্র কাল থেকেই চুপ করে আছে। সুচেতনারও ইচ্ছে জাগেনি ওকে আর কিছু বলার।
স্কুলে যখন ঢুকলো, তখন রেবতীদি বললেন, দেখ সু, তুই আজ কতগুলো ছেলে মেয়ের মা হলি।
ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েগুলোর কলকাকলীতে ভরে উঠেছে ওর 'নৃত্যমঞ্জরী নিকেতন'।
আহা...মুক্তির স্বাদ, নিজেকে আবার খুঁজে পাবার স্বাদ।
মাটিকে প্রনাম করে মাটির বুকে আবার ছন্দে পা ফেলার স্বাদ। সুচেতনা মনে মনে বললো, সাগ্নিক তুই আমাকে এভাবেই ভালোবাসিস। নটরাজের ভাঙ্গিমাতেই আমাকে দেখিস।
                  --------কলমে----অর্পিতা সরকার

No comments

এক চিলতে রোদ্দুর।

খুব সাবধানে পায়ের আওয়াজ বাঁচিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো সুচেতনা। পবিত্র ওপাশ ফিরে এখনও ঘুমাচ্ছে। বাথরুমের লাইট জ্বেলেই দুফোঁটা ইউরিন ফেললো প্...

Powered by Blogger.